পিএম বিশ্বকর্মা যোজনা: কারিগরদের ক্ষমতায়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে নতুন দিশা
লক্ষ লক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা ভারতকে একটি উন্নত জাতি হিসেবে গড়ে তোলার যাত্রার একটি অন্যতম প্রধান ভিত্তি। যদিও 'পিএম-ভিবিআরওয়াই' (PM-VBRY) এর মতো সংক্ষিপ্ত রূপগুলো কর্মসংস্থান সৃষ্টির একটি বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গিকে বোঝাতে পারে, তবে তৃণমূল স্তরে উল্লেখযোগ্য কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন চালিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হলো পিএম বিশ্বকর্মা যোজনা (PMVKS)। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক চালু করা এই প্রকল্পটি দেশের ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্প এবং দক্ষতাকে লালন করার প্রতি জাতিগত প্রতিশ্রুতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, যা একই সাথে স্ব-কর্মসংস্থান এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিপুল সম্ভাবনা উন্মোচন করছে।
ভারতের কর্মসংস্থান সৃষ্টির কৌশল উন্মোচন
কোটি কোটি কর্মসংস্থান তৈরির উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য অর্জনের জন্য দক্ষতা উন্নয়ন, উদ্যোক্তা তৈরি এবং ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি উদ্যোগ (MSMEs) সমর্থন করার উপর গুরুত্ব দিয়ে একটি বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন। পিএম বিশ্বকর্মা যোজনা একটি কৌশলগত হস্তক্ষেপ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে, যা সরাসরি 'বিশ্বকর্মাদের' – অর্থাৎ ভারতের অসংগঠিত অর্থনীতির মেরুদণ্ড গঠনকারী দক্ষ কারিগর ও কারুশিল্পীদের ক্ষমতায়ন করে। এই গুরুত্বপূর্ণ অংশটিকে উন্নীত করার মাধ্যমে, এই প্রকল্পটি কেবল ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে সংরক্ষণই করে না, বরং টেকসই জীবিকা তৈরি এবং স্থানীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতেও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে।
পিএম বিশ্বকর্মা যোজনা: একটি মূল স্তম্ভ
পিএম বিশ্বকর্মা যোজনা ১৮টি ঐতিহ্যবাহী পেশার কারিগর ও কারুশিল্পীদের সহায়তা করার জন্য তৈরি একটি ব্যাপক প্রকল্প। এর লক্ষ্য হল তাদের আনুষ্ঠানিক অর্থনীতির সাথে যুক্ত করা, তাদের পণ্য ও পরিষেবার মান ও প্রসার উন্নত করা এবং তাদের সামগ্রিক আয় বৃদ্ধি করা।
মূল উদ্দেশ্যসমূহ:
- দক্ষতা বৃদ্ধি: ঐতিহ্যবাহী কারিগরদের আধুনিক দক্ষতা প্রশিক্ষণ প্রদান করা, তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং সমসাময়িক চাহিদার সাথে মানিয়ে নিতে সাহায্য করা।
- ঋণ প্রাপ্তির সুযোগ: জামানতবিহীন প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ সুবিধা প্রদান, যা সুবিধা জনক হারে পাওয়া যাবে।
- আধুনিক সরঞ্জাম ও কৌশল: আধুনিক সরঞ্জাম কেনার জন্য আর্থিক উৎসাহ প্রদান, যা কাজের দক্ষতা ও পণ্যের মান উন্নত করবে।
- বাজার সংযোগ: বিপণন সহায়তা এবং ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে কারিগরদের দেশীয় ও বিশ্বব্যাপী বৃহত্তর বাজারের সাথে সংযুক্ত করা।
- ডিজিটাল ক্ষমতায়ন: সুবিধাভোগীদের মধ্যে ডিজিটাল লেনদেন এবং আর্থিক স্বাক্ষরতা প্রচার করা।
কারা সুবিধা পাবেন? (যোগ্যতার মাপকাঠি)
এই প্রকল্পটি 'বিশ্বকর্মা' নামে পরিচিত ঐতিহ্যবাহী কারিগর ও কারুশিল্পীদের লক্ষ্য করে তৈরি করা হয়েছে, যারা স্ব-কর্মসংস্থানের ভিত্তিতে চিহ্নিত ১৮টি পেশার একটিতে জড়িত। এই পেশাগুলোর মধ্যে রয়েছে কাঠমিস্ত্রি, নৌকা প্রস্তুতকারক, বর্ম প্রস্তুতকারক, কামার, হাতুড়ি ও সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক, তালাচাবি প্রস্তুতকারক, স্বর্ণকার, কুমোর, ভাস্কর, পাথর খোদাইকারী, জুতা প্রস্তুতকারক, রাজমিস্ত্রি, ঝুড়ি/ম্যাট/ঝাড়ু প্রস্তুতকারক, পুতুল ও খেলনা প্রস্তুতকারক, নাপিত, মালা প্রস্তুতকারক, ধোপা, দর্জি এবং মাছ ধরার জাল প্রস্তুতকারক।
আবেদনকারীর বয়স কমপক্ষে ১৮ বছর হতে হবে এবং গত পাঁচ বছরের মধ্যে কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের স্ব-কর্মসংস্থানের জন্য অনুরূপ ঋণ-ভিত্তিক প্রকল্প থেকে ঋণ নিয়ে থাকলে চলবে না। একটি পরিবার থেকে শুধুমাত্র একজন সদস্য এই সুবিধা নিতে পারবেন।
প্রকল্পের অধীনে মূল সুবিধা:
- স্বীকৃতি: একটি পিএম বিশ্বকর্মা সার্টিফিকেট এবং আইডি কার্ড।
- দক্ষতা প্রশিক্ষণ: মৌলিক (৫-৭ দিন) এবং উন্নত (১৫ দিন বা তার বেশি) প্রশিক্ষণ, সাথে দৈনিক ৫০০ টাকা করে বৃত্তি।
- টুলকিট প্রণোদনা: আধুনিক সরঞ্জাম কেনার জন্য ১৫,০০০ টাকা পর্যন্ত অনুদান।
- ঋণ সহায়তা: জামানতবিহীন উদ্যোগ উন্নয়ন ঋণ, প্রথম কিস্তিতে ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় কিস্তিতে ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ৫% সুদের হারে।
- বিপণন সহায়তা: মান যাচাই, ব্র্যান্ডিং, ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মে তালিকাভুক্তি, বাণিজ্য মেলায় অংশগ্রহণ এবং বিজ্ঞাপনের জন্য সহায়তা।
- ডিজিটাল লেনদেনে উৎসাহ ভাতা: প্রতি যোগ্য ডিজিটাল লেনদেনে ১ টাকা করে উৎসাহ ভাতা, প্রতি মাসে ১০০টি লেনদেন পর্যন্ত।
অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির স্বপ্ন
পিএম বিশ্বকর্মা যোজনা তার কর্মীবাহিনীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে ক্ষমতায়ন করার মাধ্যমে একটি উন্নত ভারতের স্বপ্ন পূরণে সরাসরি অবদান রাখছে। ঐতিহ্যবাহী কারিগরদের সফল উদ্যোক্তায় রূপান্তরিত করার মাধ্যমে, এই প্রকল্পটি কেবল ভারতের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে রক্ষা করে না, বরং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটি ঢেউও তৈরি করে। ঋণ সহায়তা কারিগরদের তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ, স্থানীয় সাহায্য নিয়োগ এবং উদ্ভাবন করতে সক্ষম করে, যা পরোক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। আধুনিক সরঞ্জাম এবং বাজার সংযোগের উপর জোর দেওয়ায় তাদের পণ্যগুলি প্রতিযোগিতামূলক হয়, যা বৃদ্ধির নতুন পথ খুলে দেয়।
যদিও ৩.৫ কোটি কর্মসংস্থানের লক্ষ্য একটি বৃহত্তর জাতীয় আকাঙ্ক্ষাকে উপস্থাপন করে, পিএম বিশ্বকর্মার মতো উদ্যোগগুলি মৌলিক ভিত্তি স্থাপন করছে। প্রতিটি ক্ষমতাপ্রাপ্ত কারিগর জাতীয় জিডিপিতে অবদান রাখেন, স্থানীয় সরবরাহ চেইনকে শক্তিশালী করেন এবং তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে কর্মসংস্থান তৈরি করেন, যা সম্মিলিতভাবে ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়ে তোলে।
উপসংহার
পিএম বিশ্বকর্মা যোজনা কেবল একটি প্রকল্প নয়; এটি ভারতের ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্পীদের স্বীকৃতি, উত্থান এবং মূলধারার অর্থনীতির সাথে একীভূত করার একটি আন্দোলন। প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, প্রশিক্ষণ এবং আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে, এটি নিশ্চিত করে যে এই অমূল্য দক্ষতাগুলি বিকশিত হতে থাকবে, যা জাতির কর্মসংস্থান লক্ষ্য এবং একটি উন্নত জাতি হওয়ার উচ্চাভিলাষী যাত্রায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।